প্রথম পর্ব

আমরা তখন যশোরে, আমার চার-পাঁচ বছর বয়স, কোনো এক দূর সম্পর্কের খালা আমাদের বাড়িতে কয়েক দিন থাকতে এলে পরে আমার সাথে দারুণ বন্ধুত্ব হয়েছিল। উনি ফিরে যাবেন আর কিছুক্ষণ পর—তার জন্য রিক্সা ডাকা হয়েছে, রিক্সার পিছনে একটা সাপ রিলেটেড সিনেমার পোস্টার টিনে আঁকা ছিল, লাল অধিকৃত, বেসামাল রকমের প্রগলভ আর কিম্ভূত। আমি বিদায়টাকে নিতে পারছিলাম না। ঘন ঘন তার নরম আলিঙ্গন, আর আমার টোল পরা গালে তার আদর, আমার বুদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বাস সবকিছুর ভেতর কেমন জানি নতুনত্ব ছিল—গত কয়েকটা দিন। আমার মানতে কষ্ট হচ্ছিল যে সে চলে যাবে। আর আমি “আবার আসব” এই সান্ত্বনায় ভুলে যাবার বয়স পার করছিলাম তখন, আর যেকোনো বিদায় যে চিরবিদায় হতে পারে তেমন আশঙ্কা সম্পর্কে আমি কিছুদিন আগেই, আমাদের বাসার সামনে যে নেড়ি কুকুরটা হেঁটে যেত, তার গাড়ি চাপা পড়ে মারা যাওয়ার ফলে, জীবনের অনিশ্চয়তা আর নশ্বরতা সম্পর্কে আমার ধারণা হয়েছিল।

পাশের বাড়ির বারান্দার রেলিং এ দাঁড়িয়ে একটা কংক্রিটের গোল প্লাস্টার আর রঙ ছুটে যাওয়া পিলার শক্ত ভাবে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে আড়াল করেছি, আমার হাত পা যেন আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, রিক্সার সাথে ছুটতে না পারে, আর যেন বুকে হু হু করা শূন্যতা কমে, সেজন্য আমার ধুকপুক বুক লেগে ছিল কংক্রিটের সাথে। পিলারটা খুব ঠাণ্ডা, আমার নরম হাতে, গালে আর হাফহাতা শার্টে সিমেন্টের চুন করা চলটা বসে যাচ্ছিল। তখন অনুভব করলাম, কেবল আমার বুকে নয়, ঊরুসন্ধিতে বিদায়জনিত একটা এক্সপ্রেশন আছে, একটা টেনশন আছে—এবং তার রিলিফের প্রচণ্ড চাপ , যেহেতু তখনও উদগীরন শেখে নাই আমার শরীর, তাই বীর্যপাত ছাড়াই—আমার চোখ ছোট ছোট হয়ে আসে উত্তেজনায়, কিংবা পুলক বলা যেতে পারে—ভয়মিশ্রিত; সাথে ক্লান্তি আর পাপবোধ।


মানিপ্ল্যান্ট

ফারুক আব্দুল্লাহ
রচনাকাল, আগস্ট ২০২১


আমার শিশ্নের এই বিকল্প ব্যবহার, সেটাকে আমার আবিষ্কার মনে হতে থাকে—যেন সে আমার দ্বিতীয় হৃদয়। আমার শৈশবের অসহনীয় আবেগ সময়ে সময়ে এইভাবে চ্যানেলাইজড হয়েছে, জিনিসটাকে আমার কাছে কেন পাপ মনে হয়েছিল, কিংবা কেন গোপন রাখতে হবে নিজে নিজে বুঝে নিয়েছিলাম—এ নিয়ে আমার এখন কৌতূহল হয়। হতে পারে প্রাইভেট কিংবা পাবলিক অঙ্গ আলাদা করার শিক্ষাটাই এই পাপবোধের উৎস? ঠিক জানি না।

আমার লেখা একটা গল্প আছে, নাম মনে নাই গল্পটার—লিখন নামের এক ছেলের গল্প। তার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে যেইদিন, সেদিন ভোরে তার ঘুম ভেঙে যায়, কেমন একটা অস্বস্তিকর ধূসর স্বপ্নে। একটা সীমানা-অচিহ্নিত মাঠে সে ব্যাট করছিল, বলটাকে তুলে মারার আগ পর্যন্ত সে দুর্গের মত স্থাপনাটা দেখে নাই। বলটা সেখানে পড়া মাত্র হৈ হৈ করে উঠল ফিল্ডাররা—”বল নিয়া আয়, বল নিয়া আয়!” অথচ সে ফিল্ডার কিংবা বোলার কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। কণ্ঠগুলোর তাড়ায় সে যখন দুর্গের ছোট দরজাটা খুলেছিল, একটা এবড়োখেবড়ো আঙিনা—সাপের সদ্য ছড়ানো খোলস আর বোম্বে সুইটসের প্যাকেট হালকা বাতাসে উড়ছি, উড়ব করছে। এসময় তার মামাত বোন এশা, যে কিনা তার থেকে দুই বছরের বড়, সে ভেজা চুল, আর বেশি সময় ধরে গোসল নেয়ার কারণে মুখটা কিছু বিবর্ণ, আর লাল নাকের ডগা, শ্বাস-প্রশ্বাসে একটু জড়তার কারণে, খুব মিহি একটা শব্দ হচ্ছে, চিবুকে লালচে তিল। বলল “এতক্ষণ লাগে আসতে?” ব্যস এতটুকুই। লিখনের ঘুম ভেঙে যায়। লিখন তারপর মাস্টারবেশন করে। তার মাস্টারবেশনটা, এশার সাথে বড় বোন আর ছোট ভাইয়ের জড়াজড়ি বিষয়ক এদ্দিনকার যে রাখঢাক, রাত জেগে হিন্দি সিনেমা দেখতে দেখতে এশার বুকে আহ্লাদে গলে পড়া, এসবের ভাইবোন-সুগারকোটেড যে আত্মপক্ষ সমর্থন ছিল, সেগুলোকে তছনছ করে দেয়।

লিখনের হাঁটু কেঁপে ওঠে। ভয় পায় লিখন, তার এই পাপের শাস্তি যে পরীক্ষার রেজাল্টে এসে পড়বে সে নিশ্চিত হয়। যদি তার খাতায় সে নাম রোলের জায়গায় ভুল গোল্লা পূরণ করে ফেলে? কিংবা একটা উপপাদ্যে x এর জায়গায় a লিখে রেখেছে বেখেয়ালে। এসব ভাবতে ভাবতে সে বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর রেলস্টেশনে গিয়ে কোনো ট্রেনে উঠে বসে, ট্রেন ছাড়া মাত্র, চারদিকের কোলাহলে সে যখন অভ্যস্ত হয়, তার পাপবোধ কমে আসে, এশাকে নিয়ে প্রকাশ্য সে ভাবে, আহা এশা যে কত নরম আর উষ্ণ!

দ্বিতীয় পর্ব

আমার নাম আবু তুরাব, আমি গল্প লিখি। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করছি খুব টেনেটুনে, অনেক সময় নিয়ে—বেশ কয়েক বছর হলো, চাকরি-বাকরিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারছি না তাই এই ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট গন্ধটা থেকে গেছে কিংবা রেখে দিয়েছি এখনো।

ব্লগে আমি যখন লেখালেখি শুরু করি তখন বাংলা ব্লগের বেশ পড়তি অবস্থা—এই সেন্সে যে, গেট টুগেদার, ভাই বোন পাতানো, প্রেম ট্রেম এসবের যে সুযোগ ছিল ২০০৬ এবং তার পরে দুই তিন বছর, ব্লগের মধ্যে যে এলিট ব্যাপারটা ছিল লেখায় লেখায় কাছে আসার, সেটা স্যাচুরেটেড হয়ে এসেছিল বিভিন্ন স্ক্যান্ডাল, ব্ল্যাকমেইল, বিদ্যার দৌড় ধরা পড়ে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে। তারপরও ব্লগে আমার লিখতে ভালো লাগত কেননা ঐখানে এক্সপেরিমেন্টাল আর ট্যাবু নিয়ে লেখা গল্পের প্রশংসা অনেক। প্রশংসায়ও আমি সর্বাঙ্গে উদ্যত বোধ করি আর সবার মত। ব্লগ ঝিমিয়ে পড়ার পর ব্লগের সমমনাদের (!) সাথে সাহিত্য সম্পর্ক আছে, মাঝে মাঝে অনলাইন পোর্টালে এবং কয়েকটা দৈনিকের সাহিত্য পাতায়ও আমার গল্প ছাপে।

আমার শৈশবের ঘটনাটা অস্বস্তিকর। অস্বস্তিকর এই অর্থে যে, পাঁচ ছয় বছর বয়সে যৌনাঙ্গ কেন্দ্রিক কোনো সেনসেশন বিষয়ে আমরা গা জোয়ারি অস্বীকারের মধ্যে দিয়ে যাই—সেটা নিয়ে আমার ভাবনা আছে, আমাকে এটা নিয়ে ভুগতে হয়েছে মূলত মানসিক ভাবে—দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার মনে হয়েছিল আমি ঠিক স্বাভাবিক না, পরে আমি মেনে নিতে শিখেছি। যৌনতার যে ফেজগুলোকে আমরা আলাদা করি—সেসব একটা ধূসর ওভারল্যাপিং এর মধ্যে দিয়ে যেতেই পারে। বর্ডার লাইনগুলো এমন কোনো খড়ি দিয়ে আঁকা কিছু নয়—খুব নাজুক এই পর্যায়গুলো। এই তো কিছুদিন আগেই উত্তরা আড়ং এ একটা পাঁচ বছর কিংবা বয়সে আরো ছোট এক বাচ্চা ছেলের সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে যায়, যখন সে একটা তার হাইটের ডামি মেয়ে পুতুলের জামা টেনে উপরে তুলে কী জানি খুঁজছিল। এই অসময় চোখাচোখির সময়, আমার চোখ স্বাভাবিকভাবে নামিয়ে নেয়া তার ভাল লেগেছিল হয়ত, পরবর্তী দুই তিন মিনিট আমরা চোখে তাকানো এবং চোখ নামানো খেলা খেলেছিলাম।

তো সেই শুষ্ক স্খলন এই অভ্যাসটা আমি জারি রাখি প্রায় এগার বারো বয়স পর্যন্ত—এর মাঝে আমি স্কুলে ভর্তি হই, ক্রিকেট, ফুটবল খেলা দেখতে শিখি, স্টিকার আর ডাকটিকেট জমাই। সেসময় এই কাজগুলোর রিলেটেড যে টেনশন, সেসবের একটা ক্ল্যাইম্যাক্স প্যাটার্ন আমি তৈরি করেছিলাম। যেমন কোনো পরীক্ষার সময়, টুকটাক কাটাকাটির জন্য আমি গোটা অংকটা কেটে দিয়ে শেষ পাঁচ মিনিটে আবার করা শুরু করি, যখন বেল বাজছে—তখন আমি বক্স কেটে “উত্তর” লিখতে গিয়েছি, সেইসময় টিচার খাতা নিলেন এবং আমার সেই ব্যাপারটা ঘটল। এরকম অযৌন ব্যাপারের যৌন এক্সিকিউশন সেই পর্যন্তই। আমার টিনএজ শুরু হওয়া মাত্রই আমার এই ব্যাপারগুলো আমি কোনোভাবে কিছুটা অস্বস্তিসহই মেনে নেই, এবং ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশনের পর পরই আমার প্রথাগত অর্থে বেশ অনিশ্চিত একটা যৌনজীবন শুরু হয়।

বয়স এবং সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করলে এই বয়সের সেক্স লাইফ অনিশ্চিত হওয়াই স্বাভাবিক, অনেক রকম উটকো ঝামেলায় যার কিছু কিছু কমিক কিছু কিছু বেশ ট্র্যাজিক—আপনি পড়বেনই। প্যান্টের বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে আবার যে রুটিনে যে কাজ আছে তা করতে ফিরে যাবেন তা ওই বয়সে সম্ভব না। সঙ্গম শেষের যে উদাসীন স্বার্থপরতা ভর করে সেটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতেই আমার অনেক সময় লেগেছে। এখনো মনে হয় না খুব স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারি। খুব কমপ্লিকেটেড হয়ে যেত ব্যাপারগুলো।

আমার অ্যাকাডেমিক অবস্থা তখন খুবই খারাপ অবস্থায় যেতে শুরু করেছে, বিভিন্ন নেশার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলাম, আর লক্ষ্য করছিলাম যেকোনো প্রেম ট্রেমে—যেটার শুরু মূলত শরীর নির্ভর (শরীর অনির্ভর প্রেম আমি কল্পনা করতে পারি না) সেসবে প্রেমের প্রলেপ দেয়ার, সামাজিক ভাবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নৈতিক ভাবেও এটাকে জাস্টিফাই করার কিছু মানসিক চাহিদা থাকে—আপনি স্ট্রিট স্মার্টনেস দিয়ে ব্যাপারটা সবসময় সামলাতে পারবেন না। যে মহিলার সাথে আপনার সম্পর্ক, মাত্র শুয়ে উঠলেন, এমন সময় তার ফোনে সে জানলো তার বাচ্চা কোনো ছোটখাটো এক্সিডেন্ট করেছে (বড়সড় এক্সিডেন্টের ক্ষেত্রে মানুষ গিল্ট ফিল্ট এসব নিয়ে ভাবার সময় পায় না, প্রেমিকের সাথে সঙ্গমকালীন অবস্থায় সন্তানের মৃত্যুর খবর শুনলে “তোমার সাথে ছেনালি করতেছি বলে এমন হইলো” বলে কেউ কাঁদবে না মনে হয়) হয়ত হাত কেটেছে কিংবা এমন ছোটখাটো কিছু—ওই অবস্থায় এমন প্রতিক্রিয়া আমার পক্ষে নেয়া কঠিন হতো। যা বললাম এমনই ঘটেছিল একবার। সে আমার থেকে বয়সে তিন চার বছরের বড় ছিল, আমাদের ফ্ল্যাটটা যে বিল্ডিং এ তার পাশের বিল্ডিং এ থাকতো—এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্বামীসহ। ওদের ফ্ল্যাটটা ছিল আমাদের একতলা নিচে, আমার জানালা দিয়ে ওদের কিচেনের চুলাটা দেখা যেত। সে মোটামুটি সারাদিনই রান্না করতো, আর গজ গজ করতে থাকতো কমবয়সে বিয়ে হবার জন্য, ওদের মেয়েটা স্কুলে পড়ে, ছেলেটার তিন-চার বছর বয়স। স্বামী ভদ্রলোক বেশ লম্বা চওড়া, উনার কণ্ঠে আমার কথা শোনা হয়নি, তবে গান শুনেছি—খুব ভরাট কণ্ঠের, বাচ্চা দুজনই তার ন্যাওটা। আমাদের বাড়ির দারোয়ানের সাথে তাদের বাড়ির দারোয়ানের কথোপকথনে জেনেছিলাম ভীষণ বউ পাগল লোক আর খুব ভালো মানুষ। তবে তিন চার সপ্তাহ পর পর বেশ ধুপধাপ আওয়াজ হতো, আর কান্না মেশানো অভিযোগ আর একটু স্পষ্ট শোনা যেত। আমি জানালার কাছে দাঁড়ালে ভারি সোনার বালা পরা দুটো হাতের নাড়াচাড়া দেখতাম, চিবুক দেখা যেত, কখনো কখনো স্তনের হালকা আভাস। এরপর ওরা অন্য কোথাও শিফট করে। ওদের বদলে যে ভাড়াটিয়ারা আসে তাদের আমার ঠিক পছন্দ হয় নাই, মানে উনারা ঠিক আগ্রহ উদ্দীপক না। দম্পতি হিসেবে অনেক পুরাতন, সম্ভবত বুয়াই রান্না করতো। রান্নার সময় ছাড়া চুপচাপ থাকতো রান্নাঘর। আমি আমার সৎ প্রতিবেশীদের অভাব এবং স্মৃতি দুটোই যখন কাটিয়ে উঠেছি প্রায়, তখন একদিন ভার্সিটি থেকে ফিরছি, দেখি এক দঙ্গল মহিলার মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন লাল শাড়ি পরা মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন—আমি নিশ্চিত হবার জন্য এদিক ওদিক তাকালাম এবং নিশ্চিত হলাম যে উনার হাসির লক্ষ্য আমিই, আমিও হাসি ফেরত দিলাম। গোলগাল ফর্সা মুখ, সারা মুখ জুড়ে খুবই মিহি পাটের আঁশের মত সাদাটে পশমের আভা। মহিলাদের ভিড় ছেড়ে সে একটু এগিয়ে আসল সামনে।

“চিনছেন?”

হাত নাড়িয়ে যখন কথা বলল তার সোনার বালা দেখে আমি আন্দাজ করতে পারলাম।

“কই গেছেন আপনারা?”

বলল “৯ নম্বর রোডে, চিনেন?”

আমি বললাম “মসজিদের রোডে না?”

সে হাসল। ঝকঝকে সুন্দর দাঁত, “আপনি তো জুম্মার টাইমেও জানালায় দাঁড়ায় থাকতেন, মসজিদ চেনেন তাইলে?”

আমি উত্তর করলাম না।

গাঁজা খেতাম তখন, আমার একদম সইতো না গাঁজা। আমি যার কাছ থেকে গাঁজা নিতাম তার নাম ছিল বাবুল মিয়া। মোটামুটি হাইটের, কিন্তু শরীর আর চোখ থেকে ঠিকরে পড়ত শক্তি। পেশায় ডোম ছিল একসময়, কাউকে হুমকির সময় বলত “ডোম বাবুল তোর মায়ের ছামার মধ্যে…।” বাবুল মিয়ার কাছে নিতাম বললাম যদিও, কিন্তু বেশির ভাগ সময় বাবুল মিয়া এই কেস ওই কেসে হাজিরা দিতে কোর্টে গিয়ে জেলে চালান হত। ওর দুইজন বউ ছিল, তারাই মূলত গাঁজা বিক্রি করতো। দুই সতীনের চমৎকার আন্তরিকতা ছিল। দুইজনের বাড়ি আলাদা ছিল, প্রায় ৫০ গজ দূরে দূরে, বিকেল বেলায় গেলে দেখা যেত একজন আর একজনের চুল বেঁধে দিচ্ছে। একবার কোনো এক জটিলতায় বাবুল মিয়া জেলে এবং তার স্ত্রীরা আত্মগোপনে। এই সময় ওখানে এক পা কাটা এক লোকের আবির্ভাব হয়, বাবুল মিয়া আর তার বউদের সে কোন প্যাঁচে ফেলে এলাকা ছাড়া করেছে সেটা সবাইকে বলত আর সাথে গাঁজা বিক্রি করতো। গলা কাটা দাম, আবার বিক্রি করার পর ও ওর নিজের বিক্রি করা পুড়িয়া থেকেই একটু নিয়ে একসাথে খাবার জন্য কাতর অনুরোধ করত। বানানোর ঝামেলা কমে যায় বিধায় আমি ওর সাথে ওখানে বসেই খেয়ে আসতাম। ও খুব কড়া করে বানাত, আমি একটু খেয়েই আর পারতাম না। একদিন বললাম, “ভাই আমার সয় না” সে তখন আমাকে বলল কোন এক মহাবীর বাইরে থেকে পিপাসার্ত হয়ে ফিরে এসেছে, ভয়াবহ গরম—এসে দেখে তার ঘরের চালে একটা বাটি—মহাবীরের হাইট ছিল প্রায় চাল ছুঁই ছুঁই, তাই মোটামুটি অক্লেশে সে বাটিটা নামায়, বোঝে সেখানে তরল কিছু আছে, পিপাসার চাপে তিনি আর দেখেন না তাতে কী আছে, তিনি যখন ঠোঁট ছুঁয়ে এক চুমুক দিয়ে ফেলেছেন, ঢোক গেলা বাকি তখন তিনি দেখলেন তার স্ত্রী ভয়ার্ত ইশারায় তাকে না করছেন।

“কী ছিল বলেন তো?” লোকটা আমাকে জিজ্ঞেস করে।

আমি বললাম “বিষ?”

সে বলে, “হ্যাঁ বিষই, কিন্তু কারো জন্য মধুও।”

তারপর আমাকে যেটা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, স্ত্রী তার সন্তানের জন্য নিজের দুধ বাটিতে করে রেখেছিল। তারপর সে বেসুরা কণ্ঠে একটা গান ধরল “কারো জন্য মধু আর কারো জন্য বিষ” (গল্পে মুচকি হেসে বীরভোগ্যা নারীটিই গানটি গেয়েছিল)

যাই হোক বিষ মধুর এই রূপকে আমি গাঁজা কার স্তনজাত দুগ্ধ আর সেটা আমার জন্য কেন বিষ সেটার আমি কোনো আধ্যাত্মিক উৎস পাই নাই। আমি ক্যানাবিস ইন্ডিউসড সাইকোসিসের একটা ফেজ পার করেছি বলেই আমার মনে হয়। ভোঁতা একটা অনুভূতি মাথায় কাজ করতে করতে হুট করে আমি যেন আশেপাশের সব কিছুর আমিকেন্দ্রিক তৎপরতায় সচেতন হয়ে উঠতাম। আর যখন আমাকে কেন্দ্র করেই এই বিষয়ী মহাবিশ্ব তার কুটিল পরিক্রমা শুরু করে—আমি তখন চঞ্চল চোখে এদিক ওদিক তাকিয়েছিলাম।

আমার চুপ থাকা আর অস্বস্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকানোতে সে গলা নিচু করে বলল, “রাগ করতেছেন?”

আমি বললাম, “না, ভিড় ভিড় লাগতেছে।”

“ভিড়ে সমস্যা কী, আপনি কি প্রেম করবেন নাকি আমার সাথে?”

আমি বললাম “না, নেশা করবো আপনাকে দিয়া।”

তার ঝকঝকে দাঁত বের হয়ে দ্রুত অস্ত গেল, “অ্যাঁ শখ কত।”

নায়িকা শাবনূর ‘আনন্দ অশ্রু’ মুভির প্রথম অংশে যে চালচলনে চলত দীপা (ওর নাম) হুবহু সেটাকে নিজের মত করে বানিয়ে নিয়েছিল।

তো যাই হোক এভাবেই আমাদের শুরু, এরপর তার ননদ এসএসসি পরীক্ষার ছুটিতে ওদের বাসায় আসলে, বাচ্চাদের তার দায়িত্বে রেখে সে রান্না শেখার কোর্স করতে বের হত। তার পরিচিত এক পরিবারের সাবলেট দেবার নিয়তে রাখা রুমটাতেই আমাদের বার, তারিখ আর ঘণ্টা ধরে রুটিন অভিসার চলেছিল। তখন বিরক্ত লাগত কিন্তু এখন ভাবতে বেশ মজাই লাগে যে আমাদের মিলন শেষে সে আমার বুকে শুয়ে তার স্বামীর সাথে সেক্সের সময় কী কী হয়েছিল সেসব বলতে থাকত।

“বুঝলা, সেদিন গেলাম না এখান থেকে, তুমি সেদিন শিউর কিছু খাইছিলা, বাপরে!”

আমি তখন অপেক্ষা করি তার বাকি কথার জন্য।

“তো রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বাবুর আব্বু ঠাইসা ধরেছিল, আমার গায়ে ব্যথা, বার বার সরাই দেই, কিন্তু সে ছাড়ে না।”

আমি তার কথার মাঝের দীর্ঘ বিরতিকে আমার প্রশ্ন দিয়ে পূরন করি, বলি, “তারপর দিছিলা?”

দীপা বলে, “না দিলে ছাড়ত? লোকটা আমারে এত মানাইতে পারে, আমারে মানায় ছাড়ছে।”
তাকে এই “মানানো”টা তার যেকোনো সম্পর্কে একমাত্র দাবি। “ব্যাটাছেলে হইছো মানাইতে পারো না?”–এইটা তার নিয়মিত অভিমান।

সে প্রতিদিন এসেই বলতো, “আজকে কিন্তু কিছু করবো না।”

আমি সম্মতি জানিয়ে তার হাত ধরে থাকলে সে ঠোঁট উল্টায় একরাশ অভিযোগ ছুঁড়ে দিয়ে বলতো, “তুমি যদি এতটুকুও মানাইতে পারো আমারে!”

আমি তাকে কথার পিঠে কথা বলে, তার রূপের প্রশংসা করে, তার ভারি ও লম্বাটে নিতম্বকে বিশ্বসেরা বলে যেভাবে মানাতাম, সে সেটাকে ঠিক মানানো মানতো না। তার মানানোর সংজ্ঞায় একটু পুশ করা, নাছোড়বান্দা আর ধূর্ততা থাকতে হত, এবং সবচেয়ে বড় কথা সে মানানো বলতে যেটা বুঝত সেটা ঠিক “কথা” নয়, অ্যাকশন।

আমাদের অভিসারের ঘরটায় আমরা ছাড়াও সম্ভবত কেউ কেউ আসতো, খুব অনিয়মিতই হয়তো। কিন্তু দীপা আমাদের ওই ক্ষণস্থায়ী আবাসটাকে টিপটপ রাখতো। সিরামিকের বাটিতে দুটো মানিপ্ল্যান্ট গাছ, একটা পাটের ছোট্ট ওয়াল ক্লথ, একটা অ্যাশট্রে, বিছানার চাদর, বালিশের কাভার ইত্যাদি ঐ ঘরে তার নিজস্ব বিনিয়োগ।

যাইহোক, দীপা আমার বুকে শুয়ে তার গতরাতের গল্প বলছে এমন সময় ফোন এলো।

“কেমন করে?”

“কত খানিক কাটছে?”

“ব্যান্ডেজ করছিস?”

“কী করতেছে?”

“আচ্ছা আমি আসতেছি”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ কার কাটছে?”

সে উত্তর না দিয়ে, কোনো তাড়াহুড়া না করে নিজের হাঁটু দুই হাতে জাপটে মাথা ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো, তার নগ্ন শরীর ঢেকে রেখেছিল তার দীর্ঘ চুল। আমার খুব খারাপ লাগছিলো, তার বাচ্চা দুটোর ছবি আমি দেখেছি, খুবই মিষ্টি বাচ্চা। স্বামী ভদ্রলোকের ছবি দেখেই আমার বেশ ভালো লেগেছিল। আমার খারাপ লাগছিল ব্যাপারটায়, ভয় ভয় লাগছিল, এর মাঝেই দীপা কান্নায় লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কারো বাচ্চার এমন হয় না, আমার বাচ্চার সাথেই হয়, হবে না, তোমার সাথে ছেনালি করতেছি, হবে না—তুমিও আমারে খারাপ মেয়েই ভাবো।”

আমি এটা সেটা বলি। সে কান্না থামায়। তারপর স্বাভাবিকভাবে চলে যায় এবং পরের দেখায় অভিযোগ করে, “তুমি সেদিন চাইলে আমারে মানাইতে পারতা।”

আমার সাথে তার ডেটের যে সময়টা ছিল, সেই সেমেস্টারে ঐসময় আমার তিন ক্রেডিটের একটা কোর কোর্স ছিল, বেশ কয়টা কোর্সের প্রিরিকুইজিট ছিল ওটা। ঐ সেমেস্টারে আমার আর ক্লাসটা করা হয় নাই।

দীপার সাথে নয় দশ মাস সম্পর্কের পর লিরা নামের বিয়াল্লিশ বছরের এক মহিলার সাথে আমার শোয়াশুয়ির মোটামুটি আমার দিক থেকে সুবিধাজনক ব্যবস্থাটা যখন হয়, এবং আট নয়মাস পরে সে তার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার কারণে আমাকে যখন রীতিমত ঘাড়ধাক্কা মত করে তাড়িয়ে দেয়—তখন আমি খুব অপমানিত বোধ করেছিলাম। এটা আমার জন্য এটা একটা প্যারাডক্স মত। দায়হীন, লক্ষ্যহীন যৌনতা যেখানে আমার চাহিদা, সেখানে আমি প্রত্যাশা করি সংবেদনশীলতা।

লেখালেখি মাধ্যমটাই এমন, ভাবনার বহুমুখিতার বাকি সব রাস্তা বন্ধ করে একটা লিনিয়ার আর পাতানো একমুখিতাকে ফোকাস করে—কেমন জানি ব্যাপারটায় একধরনের কৈফিয়তের দায় থাকে, সিকুয়েন্সিয়াল হওয়ার চেষ্টা থাকে, নিজে কেবল ব্যাকরণসিদ্ধ হতে চায় তা না, ঘটনাগুলোকে মানে তার কন্টেন্টকে সে ব্যাকরণসিদ্ধ করে তুলতে চায়। যেমন লিরার নাম ভাবা মাত্র আমার মাথায় অনেক রকম স্মৃতি আসছে, আকিব নামের একটা ছেলের কথা মাথায় আসছে—যার সাথে লিরা আর আমার প্রেমের কোনো সম্পর্কই নেই, আবার জাস্ট পলকেই আমি এত এত ঘটনা ঘুরে আসছি—আমরা তার রাবীন্দ্রিক খেয়ালে ঘুরেছি সন্ধ্যাবেলার কাশবন—অন্ধকার ছিঁড়ে দেয়া গার্ডের কর্কশ কৌতূহল আর টর্চের আলো—পাশের গার্ডকে অকথ্য গালি—সেটা আমাকে আর লিরাকে ভড়কে দিতেই। আমি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম—মানে প্রেমিকার সামনে এমন অবস্থায় যে প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ আর আপনারা লক্ষ্য করবেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গার্ডরা কিন্তু শরীর স্বাস্থ্যে বেশ সুঠাম, শোনা কথা ওরা আর্মস ক্যারি করে, তখন জি ব্লক মাত্র ডেভলপ হয়েছে, বেশ ফাঁকা ফাঁকা চারপাশ, খুব স্বাভাবিক যে জিজ্ঞেস করতেই পারে, “আপনাদের কী সম্পর্ক?”–এইসব অনেক ফ্যাক্টর বিবেচনায় আমি ঠিক মেপে পাড়ছিলাম না। আমার নার্ভাসনেস দেখে লিরা আমার হাত চেপে ধরে বলেছিল, “আমি মোটেই চাচ্ছি না তুমি এখানে হিন্দি সিনেমার নায়ক হও” এরপর সে গার্ডকে কিছুই হয়নি ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো, “এখানে যে একটা শিরিষ গাছ ছিল ওটা কবে কাটছেন?” গার্ড দুজনের আগ্রাসীজন উত্তর দেয়ার আন্তরিক চেষ্টা করে কিন্তু ঠিক মনে করতে পারে না, শিরিষ গাছ চিনতই না লোকটা, অন্যজন চিনতো। লিরা আর আমি ওদের উত্তরের জন্য না দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরেছিলাম, পিছনে কম আগ্রাসীজন আগ্রাসী গার্ডটাকে শিরিষ গাছ বর্ণনা করছিল তখন।

(লিরার সাথে প্রেমের সময়টাতে আমাকে অনেক কিছু গিলতে হয়েছিল, কলকাতা ঘেঁষা কিংবা কলকাতাই মূলত—ঋতূপর্ণের, অপর্ণা সেনের মুভি, বেঙ্গল, ছায়ানটের অনুষ্ঠান ইত্যাদি। ঋতূপর্ণের বাড়িওয়ালি সিনেমাটা বেশ ভালো লেগেছিল।)

অথচ আমি যখন লিখছি, আমাকে এটা লিখতে হচ্ছে কীভাবে পরিচিত হলাম, কেন আমাদের সম্পর্কের ইতি ঘটল ইত্যাদি। তাই লেখার বোধগম্য হবার যে জবরদস্তি সে থেকে আমি আশ্রয় নিচ্ছি প্রভাতের পালনকর্তার।

(চলবে)