মুখবন্ধ
——
লেখাটা যেহেতু আমার নয়, শামসির ওয়ালী ভাইয়ের, যার সাথে আমার দেখা হওয়া- পরিচিত হবার যে প্রাত্যহিক কিংবা নৈমত্তিক ঘটনা যেগুলোকে আমরা কী না দৈবক্রমে হওয়া বলে ভাবতে পছন্দ করি সেভাবে। আমার শামসির ওয়ালী ভাইয়ের সাথে পরিচিত হবার গোটা ঘটনা বিস্তারিত অন্য এক লেখায় আছে। সেটা প্রকাশিত হবার পরে পাঠকরা পড়ে নিতে পারেন। কিন্তু শামসির ওয়ালী ভাইয়ের একটু পরিচয় এবং তার ট্র্যাজিক অথবা ডার্ক কমেডি মৃত্যুর ঘটনাটা জানিয়ে রাখা দরকার।
শামসির ওয়ালি ভাই বাস থেকে পড়ে মারা যান। ব্যাপারটা তার বাস থেকে স্বেচ্ছা লাফ দেয়ার ঘটনা হিসেবে প্রচারিত হয়। যদিও প্রচারিত হবার কারণ তার গুরুত্ব না- বাংলাদেশে অন্তত ঢাকা শহরে এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। সমস্যাটা হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। তিনি যে অফিসে কাজ করতেন, আর দশটা কর্পোরেট অফিসের মতই সেখানেও ছোটলোকি, বিপদে ফেলা ইত্যাদি চলে। আর অফিস তো আমাদের সমাজেরই অংশ, সমাজেও যেমনটা চলে, ফুটপাথে, বস্তিতে, গুলশান বনানী ইত্যাদি অভিজাত পাড়ায়ও- দোষারোপের যে মারাত্মক খেলা, যেটা খুব হার্ম্লেস মনে হলেও কত বড় সমস্যা করতে পারে এই বোধ মানুষদের তো কমই। তো যাই হোক লিংকডিনের মত এক সিরিয়াস প্রফেশনাল মিডিয়ামে একজন লিখলেন ওয়ালী ভাইয়ের আত্মহত্যার কারণ তার বসের আচরণ। বস বেচারা যথেষ্ট ভদ্রমানুষ- তার ওয়ালি ভাইকে ব্যক্তিগত অপছন্দ থাকলেও, কখনো তার স্বভাববিরুদ্ধ শান্ত স্বভাবের বাইরে গিয়ে হয়তো একটু বেশীই আক্রমণ করে ফেলার মত ঘটনা ঘটে থাকতে পারে- যেটা যেকোন জায়গায় ঘটে। আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের স্বাধীনতা রয়েছে- আর উনি এমন কিছুই করেন নি যে তার জন্য আত্মহত্যা করতে পারে কেউ। কিন্তু ওয়ালী ভাইয়ের বস ভদ্রলোক সম্ভবত নার্ভাসনেসের কারণেও হোক আর এমন উটকো অভিযোগের কারণেই হোক- সাফাই পেশ করলেন যে ওয়ালী ভাইয়ের বৈবাহিক জীবন জটিলতায় ঘেরা- যা সত্যও। এবার তো ব্যাপারটা চলে গেল ওয়ালী ভাইয়ের পরিবারের কোর্টে, ভদ্রমহিলা নিজের সাফাই এ যা বললেন তা আরও মারাত্মক। এবার ব্যাপারটা একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। কোন এক ট্র্যাফিক পুলিস কর্মকর্তা বুদ্ধি করে সিসিটিভি ফুটেজ দেখার চেষ্টা করলেন। আল্লাহ ভালো করুক লোকটার- ঘটনাক্রমে তিনি সেই ফুটেজ পেলেনও, এটা অবশ্যই ওয়ালী ভাইয়ের প্রতিও মে বি আল্লাহর দয়া যে ঢাকা শহরে, ঐ পার্টিকুলার সিসিটিভিটা কাজ করছিল।
যাক সিসিটিভি ফুটেজে যা দেখা গেল ওয়ালী ভাই একটা ধীরে ধীরে চলন্ত বাসে উঠছেন, তার কাঁধে এক বেল্টের এক ব্যাগ, উনি গেটে উঠে সামলাতে না সামলাতেই, পেছন থেকে একটা বাইক একটু স্লো করল, বাইকে যে দুইজন ছিলেন পেছনের জন ব্যাগে হাত দিয়ে ঠিক টানার খুব জোর চেষ্টা করেন নাই, জাস্ট ছুঁয়েই বুঝেছেন যে ব্যাগটা কাঁধ থেকে টেনে খুলে নেয়া সম্ভব না, সুতরাং বাইকওয়ালা জোরে বাইক টানলেন। বাইক সামনে যাওয়ার পর- ওয়ালী ভাই বাসের রড ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, এবং বাসের স্পিড বাড়ায় সামনদিক থেকে মুখ থুবড়ে পড়ে যান। আশেপাশের গাড়িগুলোর মনে হতে পারে যে যাত্রী স্বেচ্ছায় লাফ দিয়েছেন, বাসের হেল্পারও এই কয়েক সেকেন্ডের ঘটনাটা মিস করেন। ফলে যে কারোর মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এটা বাস থেকে লোকটার আত্মহত্যার নিমিত্তে লাফ দেয়া, কিংবা বেপরোয়া বেকুবি। আর সবচেয়ে ট্র্যাজিক কমেডি এটাই যে ছিনতাইকারী বাইকার দুইজন ঘটনাস্থল থেকে তিন চার কিলোমিটার দূরে মাঝ রাস্তায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটা বাসের নিচে পড়ে। ওয়ালী ভাইয়ের উপর একাধিক গাড়ি চলে গেছিল- সুতরাং ঢাকা শহরে সেই সন্ধ্যায় তিনটা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্য হয়- যেটা কোনভাবেই দৈনিক গড় দুর্ঘটনার সংখ্যাকে প্রভাবিত করতে পারে না। শামসির ওয়ালী ভাইয়ের কর্পোরেট ভাবনার ছোট লেখাটা এখানে যুক্ত হল
ছোটলোকি হ্যাজ নো ডিফেন্স
শামসির ওয়ালী (১৯৮৯-২০২৪)
এর মাঝে কেমন করে যেন বিভিন্ন কর্পোরেট মোটিভেশনাল স্পিকারদের বিভিন্ন ভিডিও আমার সামনে আসল, আর খুব অনিচ্ছায় অনুবাদ করার লক্ষ্যে আমাকে প্রকাশক অনুরোধ করেছিলেন কিছু মোটিভেশনাল বই অনুবাদের, সেই সূত্রে স্টিভেন কোভির অতিজনপ্রিয় বইগুলো- হ্যাবিট রিলেটেড, তা বাদেও আরও কিছু বই আমার পড়ার দুর্ভাগ্য হয়েছে। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে বইগুলো নোটিশ করার পর আমি লক্ষ্য করলাম আমার কাজের কারণে যে মিডলেভেলের এক্সিকিউটিভদের রুমে যাওয়া হয় সেখানে আমি লক্ষ্য করতে থাকলাম এই বইগুলোই। এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ অবজারভেশন না আমার এই লেখায়। আমি জাস্ট আপনাদের স্মরণ করে দিতে চাই আমাদের এই সো-কোল্ড কর্পোরেটের বয়স কত?
বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, গ্রীনলেস ব্যাংক, কিছু শিপিং, শেভরন কিংবা এরকম তেল গ্যাস কোম্পানি ইত্যাদিকে স্মরণ রেখেই বলা যায়, আমাদের সো-কল্ড যে কর্পোরেট যে কালচার তা মধ্যবিত্তের কাছে দৃশ্যমান টেলিকমগুলো আসার পর থেকে, মোটা দাগে বলা যায় যে কর্পোরেট আমরা দেখছি তা আসলে আমরা আরোপ করে নিয়েছি। হলিউড বলিউডের গলফ ক্লাবে দেখা হওয়া দুই সেয়ানা সিওর পোকার ফেস করে পরস্পরকে রিড করা ইত্যাদিকে আমরা আমাদের বাস্তবতা ধরে নিলাম।
এরপর শুরু হল যে সফলতার জন্য পজেটিভ হওয়া, ওকে ল্যাং দেয়া সব জায়েজ, প্রফেশনালিজম বলে এক আজব জগাখিচুড়ি আমাদের জন্য পাকিয়ে ওঠা শুরু করল। আর সাথে বাজার তৈরি হল- কোন ডেজিগনেশনের লোকের বাচ্চা কোন স্কুলে পড়বে, ইন্টার কিংবা এ লেভেলের পর কানাডা যাবে নাকি মালয়েশিয়া, কোন গাড়িতে চলবে, কোন টিভি সিরিজ দেখবে, কোন ভিডিও গেম খেলবে এটা নির্দিষ্ট হয়ে গেল।
এগুলো কোন সমস্যা হতনা যদি আমাদের অর্থনীতি কিংবা মোড অফ প্রোডাকশন সত্যি সত্যি ক্যাপিটালিস্ট হতে পারত। একটা ক্রনি ক্যাপিটালিজমে এটা যে কী মারাত্মক টাইম বোম আমরা পুঁতে রাখছি তা আমরা বুঝতে পারছি না।
ভারতের উদাহরণও আমাদের জন্য অনুকরণীয় নয়- ওদের মধ্যবিত্তের বয়স প্রায় দেড় শতাব্দীর, ঐ সমাজ এটাকে নিজের মত সেটেল করে নিয়েছে, ওদের ম্যাচিউরিটি বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের যে সমাজ ব্যবস্থা এতে আমরা কর্পোরেট নৈতিকতা বলে যে খোলামেলা ঔদ্ধত্য, গা জোয়ারি এবং আনসাসটেইনেবল সামাজিক সম্পর্কের ডাইনামিক্স তৈরি করছি আমার মনে হয় আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা ঝুঁকিপূর্ন হতে যাচ্ছে। আমাদের একই বয়সী বাচ্চারা পরস্পরকে আদার্স বলে ভাবতে শুরু করেছে- আর যখন কী না এই আদার্স ট্যাগটা লাগে তখন খুব সাধারণ মানুষ তার কাছে আদার্স অনুভূত হওয়া মানুষকে মারাত্মক হিংস্র আক্রমণে যেতে দ্বিধা করে না। আমি শামসির ওয়ালী এই আদার্সনেসের শিকার হয়েছি আমার প্রতি পদে পদে। আমার জন্য বেঁচে থাকা খুব কনসাস এক প্রক্রিয়া, আমি স্বভাবতই অগোছাল, ভাবুক মত, সোশ্যাল ইনসেন্টিভ আমার ভেতর কাজ করে না। আমার সাথে কেউ খুব অথোরিটি নিয়ে কমিউনিকেট করার ট্রাই করলে আমাকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করতে হয়, যেটা অপরপক্ষকে ধারণা দেয় আমার নার্ভাসনেসের- কিন্তু আমার ভেতর প্রবল সেন্স অফ গিল্ট কাজ করে। আমার কৈশোর কেটেছে এক নিষ্ঠুর কিশোর হিসেবে, আমি প্রতিটি অথোরিটিকে ক্রমে অপদস্থ করেছি- বড় হবার পর বুঝতে পারি যে মানুষগুলোকে আমি তাঁদের ভেগ ফিলিং অফ পাওয়ারের জন্য পাল্টা আক্রমণ করেছি- তা ইনসাফ হয় নাই, খুব খারাপ লাগে এখন। আমার মনে হয় এর কোন দরকার ছিল না। ওরা আমাকে আদার্স ভাবলেও আমি তো জানি আমার সমাজকে- আমার মনে হয় আমি এখন স্মার্টার সুতরাং আমি ভালো হচ্ছি আগের থেকে। কিন্তু আমার এসব অদরকারী, প্রফেশনাল আউটপুটের সাথে যেগুলোর আদৌ কোন সম্পর্ক নাই সেসব রিচুয়াল যারা পালন করছে কর্পোরেট নৈতিকতা হিসেবে তাঁদের আহবান করতে ইচ্ছা করে অন্যভাবে ভেবে দেখতে।
আমরা যা কর্পোরেট প্রফেশনালিজমের নামে ঔন করানো হচ্ছে তা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বিশ্বাস করেন এসব ছোটলোকি সব জায়গায় হয়। বস্তিতে যখন হয়, বস্তির বাসিন্দারা এটাকে র্যাশনালাইজ করে নিজেদের দুর্ভাগ্য হিসেবে- অথচ আমরা যে ৫০ এর দশকের সদাগরি অফিসের অপরিবর্তীত ভার্সনকে কর্পোরেট বলে গ্লোরিফাই করছি- সেখান থেকে তুলে নিচ্ছি আমাদের প্রায় দেড় দুই দশক আগেও বর্তমান থাকা নৈতিকতাবোধকে। আমরা এন্ডোর্স করছি এটাকে, আমরা বলছি এটাই নিয়ম।
আমাদের সমাজে ছোটলোকি থাকবেই, কিছু মানুষের ইন্সটিংক্ট লেজিটিমেট হবে না- এটাই বাস্তবতা, সুতরাং কর্মক্ষেত্রেও তাই হবে- ছোটলোক, স্বভাবত হিংস্র, প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ থাকবেই। কিন্তু ছোটলোকি নিয়ম কিংবা স্বাভাবিক হতে পারে না। এটা নৈতিক আলাপের জায়গা থেকে বলছি না, এটা বলছি সাসটেইনিবিলিটির জায়গা থেকে, আমরা অবশ্যই কর্পোরেট হব, আমরা অবশ্যই বিশ্বের বড় কর্পোরেশনের সাথে ফাইট করার মত মেধা আর ক্ষমতা রাখি- কিন্তু সেটার উইপন এই ‘নৈতিকতা কম্প্রোমাইজ’ হতেই পারে না- এটা কাজ করে না। যেহেতু খেলার নিয়ম না থাকলে খেলাও থাকবে না।
আর সত্যি- ছোটলোকি হ্যাজ নো ডিফেন্স।
শামসির ওয়ালি/ ২০২১